ভারতীয় বিমানবাহিনীর দীর্ঘকালীন কঙ্কালসার যুদ্ধবিমান মিগ-২১ অবশেষে তার শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ১৯৬০-এর দশক থেকে ভারতের আকাশরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা এই সোভিয়েত-নির্মিত ফাইটার জেটের এখন বিদায়ের সময়। অন্যদিকে, চীন দ্রুত তাদের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান J-20 Mighty Dragon-এর সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারত সরকার বিদেশি পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান কেনার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে — এবং প্রশ্ন উঠছে, F-35 না Su-57?
ভারতের সামনে বিকল্প দুটি আধুনিক যুদ্ধবিমান
বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ও শক্তিশালী পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানগুলোর মধ্যে দুটি হলো:
- F-35 Lightning II (যুক্তরাষ্ট্র)
- Su-57 Felon (রাশিয়া)
ভারতের কাছে বর্তমানে কোনও কার্যকর পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান নেই। নিজস্ব উদ্যোগে HAL-এর নেতৃত্বে তৈরি Tejas বা DRDO-র AMCA এখনও প্রকল্প পর্যায়ে রয়েছে। ফলে বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করেই নিকট ভবিষ্যতে দেশীয় বায়ুসেনার আধুনিকীকরণ করতে হবে।
F-35 বনাম Su-57: বৈশিষ্ট্য তুলনামূলক চিত্র
| বৈশিষ্ট্য | F-35 Lightning II (US) | Su-57 Felon (Russia) |
|---|---|---|
| শ্রেণি | পঞ্চম প্রজন্মের মাল্টিরোল | পঞ্চম প্রজন্মের মাল্টিরোল |
| রাডার এভয়ডেন্স (Stealth) | অত্যন্ত উচ্চমানের | উচ্চ, কিন্তু F-35 থেকে কম |
| গতিবেগ | Mach 1.6 | Mach 2.0 |
| রেঞ্জ | ~2,200 কিমি | ~3,500 কিমি |
| অস্ত্র বহন ক্ষমতা | 8,200 কেজি (আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক) | 10,000 কেজি (সর্বোচ্চ) |
| সফটওয়্যার ও সেন্সর | উন্নত AI এবং সেন্সর ফিউশন | উন্নত কিন্তু AI তুলনামূলক কম |
| অপারেটিং ব্যয় (ঘণ্টাপ্রতি) | $36,000 (আনুমানিক) | $25,000 (আনুমানিক) |
| একক ইউনিট মূল্য | $80-100 মিলিয়ন | $50-70 মিলিয়ন |
| রপ্তানির অনুমতি | কড়া মার্কিন নীতির অধীন | নমনীয় রাশিয়ান রপ্তানী নীতি |
কেন এই মুহূর্তে প্রয়োজন পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান?
ভারতের প্রতিবেশী দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী — চীন ও পাকিস্তান — এদের বিমান যুদ্ধ ক্ষমতা দ্রুত বাড়াচ্ছে। চীন ইতিমধ্যেই ২০০-র বেশি J-20 যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে। পাকিস্তান চীনের সঙ্গে যৌথভাবে JF-17 Block III তৈরি করছে, যেখানে AESA রাডার, স্টিলথ প্রযুক্তি ও লং-রেঞ্জ মিসাইল ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভারতের বর্তমান স্কোয়াড্রন সংখ্যা ৩২-এ নেমে এসেছে, যেখানে ৪২ স্কোয়াড্রনের প্রয়োজন। এমন পরিস্থিতিতে পুরনো মিগ-২১ অবসরে যাওয়ার পরে ফাঁকা স্থান পূরণে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান অতি জরুরি।
ভারতীয় প্রেক্ষাপটে F-35: সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা
F-35 যুক্তরাষ্ট্রের Lockheed Martin-এর তৈরি। এটি আজ পর্যন্ত সবচেয়ে টেকনোলজিক্যালি অ্যাডভান্সড ফাইটার জেট। মার্কিন মিত্র দেশগুলোর মধ্যে F-35 ব্যবহারে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় — যেমন ইজরায়েল, জাপান, অস্ট্রেলিয়া। ভারত QUAD অংশীদার হলেও, F-35 বিক্রিতে এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়নি।
প্রতিবন্ধকতাগুলি:
- মার্কিন রপ্তানির কড়া শর্তাবলী
- ভারতের রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা
- হাই-মেইনটেন্যান্স খরচ ও দীর্ঘ প্রস্তুতিপর্ব
Su-57: রাশিয়ার বিকল্প এবং ভারতীয় পরিচিতি
রাশিয়ার Su-57 প্রকল্পে ভারত শুরুতে অংশীদার ছিল (FGFA প্রকল্প)। কিন্তু প্রযুক্তি হস্তান্তর ও উৎপাদন সংক্রান্ত বিতর্কে ২০১৮ সালে ভারত সেই প্রকল্প থেকে সরে আসে। এখন ভারত আবার Su-57 কেনার বিষয়ে আগ্রহী হতে পারে, কারণ:
- রাশিয়া প্রযুক্তি হস্তান্তরে নমনীয়
- Su-30MKI অপারেটিং অভিজ্ঞতা থাকায় মিল রয়েছে
- খরচ তুলনামূলকভাবে কম
তবে চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
- Su-57 এখনও পুরোপুরি সিরিয়াল প্রোডাকশনে আসেনি
- স্টিলথ প্রযুক্তিতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে
- ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তী রাশিয়ার সরবরাহ-যোগ্যতা নিয়ে অনিশ্চয়তা
ভারতের নিজস্ব প্রকল্প AMCA: কবে বাস্তবায়ন?
ডিআরডিও ও এয়ারোনটিকাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (ADA) বর্তমানে Advanced Medium Combat Aircraft (AMCA) তৈরি করছে, যা ২০৩২-এর মধ্যে ফ্লাইং ফেজে যাওয়ার পরিকল্পনায় রয়েছে।
| প্রকল্প | লক্ষ্য | সম্ভাব্য উড্ডয়ন | অপারেশনাল হতে পারে |
|---|---|---|---|
| AMCA Mark-1 | ৫ম প্রজন্ম | ২০২৮ | ২০৩২ |
| AMCA Mark-2 | ৬ষ্ঠ প্রজন্ম (আংশিক) | ২০৩৩ | ২০৩৭ |
অতএব, অন্তত ৮-১০ বছর ভারতে নিজস্ব পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার আসার সম্ভাবনা নেই। সেই সময়ের জন্য F-35 বা Su-57-এর মতো বিদেশি বিকল্প অপরিহার্য।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও জিওপলিটিকাল সমীকরণ
ভারত কেবল অস্ত্র কিনতে চায় না — প্রযুক্তি স্থানান্তর, মেক ইন ইন্ডিয়া এবং যৌথ উৎপাদনের দিকেও নজর দিচ্ছে। এ কারণে রাশিয়া তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে চাইলে F-35 আলোচনায় আসতে পারে।
ভারতীয় বিমানবাহিনী এই মুহূর্তে “Multi-Role Fighter Aircraft (MRFA)” প্রকল্পের অধীনে ১১৪টি যুদ্ধবিমান কেনার কথা ভাবছে, যার আনুমানিক মূল্য ২০ বিলিয়ন ডলার।
উপসংহার
মিগ-২১ যুগের অবসান নতুন অধ্যায়ের সূচনার প্রয়োজন সৃষ্টি করেছে। ভারতের নিরাপত্তা এবং আকাশ প্রতিরক্ষার ভবিষ্যতের জন্য পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার অপরিহার্য। তবে F-35 এবং Su-57-এর মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র প্রযুক্তি দিয়ে নয়, জিওপলিটিকস, ব্যয়বহুল রক্ষণাবেক্ষণ, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং কূটনৈতিক স্থিতিশীলতার নিরিখেও নেওয়া হবে।
ভারত যদি সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়, তবে এশিয়ার আকাশে দেশের আধিপত্য ধরে রাখা সম্ভব।
Disclaimer: এই প্রতিবেদন তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণের উপর নির্মিত। বিভিন্ন প্রতিরক্ষা সংস্থা, গণমাধ্যম ও সরকারি উৎস থেকে সংগৃহীত উপাত্ত অনুসারে লেখা হয়েছে। পরিস্থিতি ও তথ্য সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে। পাঠকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে যে তারা সরকারী বা নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে চূড়ান্ত তথ্য যাচাই করে নিন।
